মা ফাতেমার জীবন কাহিনী: Bangla

by Jhon Lennon 31 views

মা ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও খাদিজা (রাঃ)-এর কন্যা। তিনি ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মা ফাতেমার জীবন কাহিনী শুধু মুসলিম নারীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়। তাঁর ত্যাগ, ধৈর্য, আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এই আর্টিকেলে আমরা মা ফাতেমার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব।

ফাতেমা (রাঃ)-এর জন্ম ও শৈশব

ফাতেমা (রাঃ)-এর জন্ম মক্কাতে হয়। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও খাদিজা (রাঃ)-এর কনিষ্ঠ কন্যা। তাঁর জন্মগ্রহণের সময়, মক্কার সমাজে কন্যা সন্তানদের খুব একটা সমাদর করা হতো না। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর কন্যাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। ফাতেমা (রাঃ)-এর শৈশব কাটে তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে। খাদিজা (রাঃ) ছিলেন একজন বুদ্ধিমতী ও দৃঢ়চেতা নারী। মায়ের কাছ থেকে ফাতেমা (রাঃ) অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, নম্র ও দয়ালু। দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রায়ই ফাতেমা (রাঃ)-কে নিয়ে মসজিদে যেতেন এবং ইসলামিক শিক্ষা দিতেন। ফাতেমা (রাঃ) খুব সহজেই কোরআনের আয়াত ও নবীর বাণী মুখস্থ করে ফেলতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। শৈশবে ফাতেমা (রাঃ) মক্কার নারীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজে সাহায্য করতেন। তিনি নারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং তাঁদের ইসলামিক জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করতেন। ধীরে ধীরে ফাতেমা (রাঃ) একজন বিদুষী নারী হিসেবে পরিচিত হন। তাঁর মিষ্টি ব্যবহার ও জ্ঞানের কারণে অনেকেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে শুধু কন্যা হিসেবে নয়, একজন ভালো বন্ধু ও পরামর্শদাতা হিসেবেও দেখতেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি ফাতেমা (রাঃ)-এর মতামত নিতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। এভাবেই ফাতেমা (রাঃ) শৈশব থেকেই একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন। তাঁর জীবন ছিল ইসলামের আলোয় আলোকিত।

ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন

ফাতেমা (রাঃ)-এর যখন বিবাহের বয়স হয়, তখন অনেক সাহাবী তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে ফাতেমার জন্য মনোনীত করেন। আলী (রাঃ) ছিলেন নবীর চাচাতো ভাই এবং ইসলামের প্রথম দিকের অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁদের বিবাহ ছিল খুবই সাদাসিধে। বিবাহের পর ফাতেমা (রাঃ) ও আলী (রাঃ) একটি সাধারণ বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। ফাতেমা (রাঃ) নিজের হাতে সংসারের কাজ করতেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী। আলী (রাঃ)-এর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তাঁরা দুজনে মিলেমিশে একটি সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করতেন। তাঁদের সংসারে হাসান ও হুসাইন নামে দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ফাতেমা (রাঃ) তাঁর সন্তানদের ইসলামিক আদর্শে মানুষ করেন। তিনি তাঁদের কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা দেন এবং ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন একজন ধৈর্যশীল নারী। জীবনের অনেক কঠিন সময়েও তিনি ধৈর্য হারাননি। আলী (রাঃ)-এর আর্থিক অবস্থা সবসময় ভালো ছিল না। অনেক সময় তাঁদের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতো। কিন্তু ফাতেমা (রাঃ) কখনো কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি সবসময় আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখতেন এবং অল্পতে তুষ্ট থাকতেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তাঁরা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সবসময় একে অপরের পাশে থাকতেন। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন আলী (রাঃ)-এর জন্য একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ও পরামর্শদাতা। আলী (রাঃ) যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ফাতেমা (রাঃ)-এর পরামর্শ নিতেন এবং তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। ফাতেমা (রাঃ)-এর ত্যাগ, ধৈর্য ও ভালোবাসার কারণে তাঁদের দাম্পত্য জীবন সকলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ফাতেমা (রাঃ)-এর ইসলামের খেদমত

ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক। তিনি সবসময় ইসলাম প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মক্কায় যখন মুসলিমদের উপর অত্যাচার চলছিল, তখন ফাতেমা (রাঃ) নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তিনি আহত মুসলিমদের সেবা করতেন এবং তাঁদের খাবার সরবরাহ করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও ফাতেমা (রাঃ) ইসলামের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি মসজিদে নববীতে নারীদের ইসলামিক শিক্ষা দিতেন এবং তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ফাতেমা (রাঃ) দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করতেন। তিনি নিজের সাধ্যমতো তাদের খাবার, বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিতেন। তিনি ছিলেন একজন দানশীলা নারী। ফাতেমা (রাঃ) বিভিন্ন যুদ্ধে আহত মুসলিমদের সেবা করতেন। তিনি তাঁদের ক্ষত পরিষ্কার করতেন, ওষুধ দিতেন এবং তাঁদের মনোবল বাড়াতেন। তিনি ছিলেন একজন সেবিকা। ফাতেমা (রাঃ) নারীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। তিনি ছোট ছোট দল গঠন করে নারীদের বাড়িতে গিয়ে কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা দিতেন। তিনি ছিলেন একজন প্রচারক। ফাতেমা (রাঃ) সবসময় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পাশে থাকতেন। তিনি নবীকে মানসিকভাবে সাহস যোগাতেন এবং তাঁর কাজে সাহায্য করতেন। তিনি ছিলেন নবীর একজন সহযোগী। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন একজন বিদুষী নারী। তিনি কোরআন, হাদিস ও ফিকহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন। তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথ দেখাতেন। ফাতেমা (রাঃ)-এর ইসলামের প্রতি অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন ইসলামের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন থেকে আমরা ত্যাগ, ধৈর্য, সেবা ও ইসলামের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা পাই।

ফাতেমা (রাঃ)-এর চারিত্রিক গুণাবলী

ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন অসাধারণ কিছু চারিত্রিক গুণের অধিকারিণী। তাঁর চরিত্র ছিল মাধুর্য ও মহত্ত্বের সংমিশ্রণ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। দরিদ্র ও অসহায়দের কষ্ট দেখলে তাঁর হৃদয় ব্যথিত হতো। তিনি সবসময় তাদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। জীবনের কঠিন সময়েও তিনি ধৈর্য হারাননি। তিনি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সবকিছু সহ্য করতেন। তাঁর এই গুণটি তাঁকে অন্যদের কাছে আরও বেশি সম্মানিত করেছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। তিনি সবসময় নিজেকে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে মনে করতেন। এই বিনয় তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন সত্যবাদী ও বিশ্বাসী। তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না এবং কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেন না। তাঁর এই গুণটি তাঁকে সকলের কাছে বিশ্বস্ত করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লজ্জাশীল ও শালীন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ও কথাবার্তায় সবসময় শালীনতা প্রকাশ পেত। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নারী। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন আল্লাহভীরু ও ইবাদতগুজার। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন এবং অন্যান্য ইবাদত করতেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক নারী। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন পরোপকারী ও দানশীল। তিনি নিজের সাধ্যমতো অন্যদের উপকার করতেন এবং দান করতেন। তিনি ছিলেন একজন মানবদরদী নারী। ফাতেমা (রাঃ)-এর চারিত্রিক গুণাবলী তাঁকে ইসলামের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাঁর জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।

ফাতেমা (রাঃ)-এর মৃত্যু

নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর কয়েক মাস পর ফাতেমা (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। পিতার বিচ্ছেদ তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। অবশেষে, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। ফাতেমা (রাঃ)-এর মৃত্যুর খবরে মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। ফাতেমা (রাঃ) অল্প বয়সে মারা গেলেও তিনি ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর জীবন থেকে আমরা ত্যাগ, ধৈর্য, আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য ও পরিবারের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা পাই। ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ নারী। তাঁর জীবন কাহিনী যুগে যুগে মুসলিম নারীদের অনুপ্রাণিত করবে। ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবন আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।

এই ছিল মা ফাতেমার সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক আমাদের জন্য অনুকরণীয়। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।